মানব জীবনে ইস্তিগফার বা তাওবার গুরুত্ব

“মানুষ দরিদ্রতাকে যতটুকু ভয় করে, ততটুকু ভয় যদি আল্লাহ-কে করত, তাহলে সে জান্নাতী হয়ে যেত”। মানুষের জন্মগত অন্যতম প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলঃ “নগদে বিশ্বাসী”। মানুষ জাতি সব কিছু নগদ চায়। ‘মজা নেওয়া’ এবং ‘মজা লাগানো’ বিষয়ে ১ সেকেন্ড দেরি হওয়ার উপর ছবর করতে চায় না। আল্লাহ্‌ ঈমান ও ভাল কাজের বদলায় জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ মুসলিম এই ওয়াদা সম্পর্কে উদাসীন এবং তাদের অন্তরের অনুভূতির দরজা তালাবদ্ধ।

এটা এই কারনেই যে, তারা দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয় পরকালের উপর। দুনিয়া নিয়ে পেরেশান, দুশ্চিন্তায় সর্বদা অস্থির। গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী বলেছেন মুসলিমদের অধঃপতন হওয়ার একমাত্র কারন ভোগ-বিলাসিতা।

শুধু ইসলামের এই মহান ব্যক্তিটিই নন, সকল ওলী, ঈমাম, ইসলামিক স্কলার সহ প্রকৃতির বাস্তবতাও বলে, শুধুমাত্র ‘ভোগ-বিলাসিতা’ মুসলিমদের ধ্বংস করে দিয়েছে। চার খলিফার পর ইসলামের শাসন ব্যবস্থা কি ছিল এবং এর কারন সমুহ আমরা সকলেই জানি। এই ভোগ-বিলাসিতা মানুষের অন্তরে ‘নগদ পাওয়া’-কে অত্যান্ত মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্তরে ঈমান রাখা, প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, রমজানে রোজা রাখা, মাল থাকলে যাকাত দেওয়া এবং হজ্জ্ব করা, ইচ্ছা হলে তাহাজ্জুদ নামাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বদা জিকিরে থাকা, সৎকর্মশীল হওয়া, স্বভাব নম্র ও বিনয়ী করা, অঙ্গীকার রক্ষা করা, মদ পান না করা, মিথ্যা না বলা, চুরি না করা, অন্যের হক নষ্ট না করা, গীবত না করা, সুদের লেনদেন না করা…… এ সকল বোঝার জন্য কোন স্কলার বা পীর বা ঈমামের প্রয়োজন নেই, প্রত্যেকের চিন্তাশক্তি যথেষ্ট।

বেহেস্তের রাস্তা তৈরি করার জন্য, আল্লাহ্‌ মৌলিক জ্ঞান ও বোঝ সবাইকে দিয়েছেন, আর এরজন্য কারো কোন জ্ঞানের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সমাজের চারপাশে সকল মুসলিমদের যে স্বভাব-চরিত্র লক্ষ্য করা যায় তারা অর্থ-ক্ষমতা, ভোগ-বিলাসিতার বিনিময়ে অল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যতীত সকলেই ঈমান বিক্রি করে দিবে। নৈতিকতা বোধ মুসলিম দাবীকারীদের মধ্যে কমই দেখা যায়।

 

“লজ্জ্বাশীলতা”-র অনেক স্তর আছে এবং আছে প্রকারভেদও। আমরা বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। যার অন্তরে আল্লাহ-র ভয় এবং লজ্জ্বাশীলতা নাই, সে কিভাবে নিজেকে মুসলিম দাবী করে? যারা নগদে সব কিছু পেতে চায় তাদের অন্তরে লজ্জ্বাশীলতা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। ভোগ-বিলাসিতার ভিতরে ঈমান ধরে রাখা যায় না আর লজ্জ্বাশীলতাও অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় না। ইস্তিগফার বা তওবা হচ্ছে লজ্জ্বিত হওয়া। নিজ কৃত কর্মের উপর লজ্জ্বিত হওয়া। যখন কৃত কর্মের জন্য লজ্জ্বিত হবে এবং লজ্জ্বা যখন বিবেককে ঝাঁকুনি দেওয়া শুরু করবে তখন অন্তরে আসে ‘আনুশোচনা’। নিজেকে তিরস্কার করতে থাকবে অনুশোচনার মাধ্যমে। দৃঢ় সংকল্প করবে আর যেন গুনার কাজ না হয়।

১. লজ্জ্বাশীলতা

২. অনুশোচনা

৩. গুনাহের কাজ বন্ধ করা

৪. দৃঢ় সংকল্প হওয়া যেন আর কখনও গুনাহর কাজ না হয়।

৩ এবং ৪-কে মজবুত করে ২; ২-কে মজবুত করে ১ আর ১-কে মজবুত করে ‘উত্তম চরিত্র’।

 

সাহাবীগন তারাও জীবন নির্বাহ করতেন, তাদেরও পরিবার ছিল, তাঁরাও ব্যবসা করতেন, কৃষি কাজ করতেন। সবকিছু ফেলে দিনরাত শুধু ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন না। প্রশ্ন আসেঃ- সাহাবীগন কি আমল করতেন যার কারনে তাঁরা জান্নাতের সর্ব উচু স্তরে মর্যাদাশীল হয়েছেন? আর এর উত্তর একটিই, সেটি হল উত্তম চরিত্র। তাদের আখলাক ছিল অত্যান্ত উচু স্তরের। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত… সবকিছুর মূল্যের গভীরতার পরিমান কার কতটুকু হবে তা নির্ভর করে যার যার আখলাক বা চরিত্রের উপর। ২ জন ব্যক্তি জামাতে একসাথে একই ফজরের সালাত আদায় করেছে।একজনের ফজরের নামাজের পুরষ্কার ২২ আর আরেকজনের ফজরের নামাজের পুরস্কার ২২ মিলিয়ন। অনেক বেশি ব্যবধান হওয়ার কারন আখলাক বা উত্তম চরিত্রের কারনে। আর এই কারনেই সাহাবীগন উচু স্তরে পৌঁছে গেছেন।

 

কারো যদি নিয়ত থাকে আবার গুনাহ কাজে লিপ্ত হওয়ার তাহলে তার তওবা কবুল হবে না। কেউ অনু পরিমান গুনাহ-র কাজ করার সংকল্প করে থাকে তার পক্ষে উত্তম চরিত্র গঠন করা সম্ভব না। সুদের লেনদেন, মিথ্যা বলা, অঙ্গীকার রক্ষা না করা…… অর্থাৎ কেউ যদি জেনেশুনে পাপ কর্ম করে এবং করেই যেতেই থাকে, তার তওবা কবুল হবে না।

“তওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলেই বলে আমি এখন তওবা করছি। তওবা তাদের জন্যেও নয়, যাদের মৃত্যু হয় অবিশ্বাসী অবস্থায়,এরাই তারা, যাদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি। (সুরা নিসাঃ ১৮)”

তবে মানুষ ভুল করে। কারো যদি ভুল হয়ে যায় কিংবা ভুল ক্রমে কোন গুনাহ-র কাজ হয়ে গেলে সেইজন্য সে পাকড়াও হবে না। নিজেকে সংশোধন করে নিলেই হবে।

কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য সীমানা এইটুকুই- “আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম। (সুরা নাহলঃ ১২৬)”

 

২ রাকাত নফল নামাজের মাধ্যমে সিজদায় তওবা করা উত্তম যে কোন সময়ে। ফযরের নামাজের পূর্বে এবং রাত্রির শেষ এক তৃতীয়াংশ সময় আরো উত্তম। আর নিচের দেওয়া ইস্তিগফার মুুুুমিনদের জন্য অক্সিজেন।

أستغفر الله ربي من كل ذنب وأتوب إليه لا حول ولا قوة إلا بالله العلي العظيم

 

আমি আমার প্রভু আল্লাহর কাছে সকল গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর দিকে রুজু করছি (অভিমুখী হচ্ছি)। সমুচ্চ সুমহান আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (আমার) না আছে (গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার) ক্ষমতা, না আছে (নেক আমল সম্পাদনের) শক্তি।

 

أستغفرالله- আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি আল্লাহর কাছে

ربي- আমার প্রভু

من- থেকে

كل- সকল

ذنب- গুনাহ/পাপ

و- এবং

أتوب- আমি তওবা করছি/রুজু করছি/অভিমুখী হচ্ছি

إليه- তাঁর দিকে

لا- নেই

حول- ক্ষমতা/সামর্থ্য

و- এবং

لا- নেই

قوة- শক্তি

إلا- ব্যতীত/ছাড়া

بالله- আল্লাহর সাহায্য

العلي- সমুচ্চ

العظيم- সুমহান

 

প্রথম প্রকাশ: সদালাপ (মোঃ তাজুল ইসলাম)